প্লাইস্টোসিন যুগে বাংলাদেশের ভূ-ভাগ গঠনের মাঝমাঝি সময়ে শৈলকুপা বঙ্গীয় ব-দ্বীপের গাঙ্গেয় নদী বিধৌত পলি মাটি গৌরি বা গড়াই, কুমার, কালী, ডাকুয়া ইত্যাদি নদী দ্বারা পলিবাহিত হয়ে এ অঞ্চলে ভূমিরূপ গঠন হয় এবং জনবসতি গড়ে উঠতে থাকে। প্রাগৈতিহাসিক আমলের উল্লেখযোগ্য কোন তথ্য না জানা গেলেও খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দে এখানে প্রথম মানব বসতি গড়ে ওঠে।
আদিকালে জীবিকান্বেষণে উর্বর ভূমির সন্ধানে ব্যাপৃত বিভিন্ন নৃগোষ্ঠির লোকেরা এখানে মানব বসতি গড়ে তোলে। নৃত্বাত্ত্বিক বিশ্লেষণে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশের সংমিশ্রণে এক শংকর জাতি এ অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। ভাষার বংশবিচারে অষ্ট্রিক প্রভাব বেশি পরিলক্ষিত হয়। গ্রিক ও ল্যাটিন ইতিহাসবিদদের রচনা থেকে জানা যায় এ অঞ্চলে গঙ্গারিডই নামে এক শক্তিশালী জাতির বাস ছিল যার রাজধানী ছিল গঙ্গারেজিয়া। পরেশনাথ মজুমদার এই গঙ্গারেজিয়া যশোর জেলার অন্তর্গত বলে অনুমান করেছেন যা সতীশচন্দ্র মিত্রের যশোর-খুলনার ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ পাওয়া যায়। ৫৫০-২০০ খ্রি. পূর্ব পর্যন্ত মৌর্য সাম্রাজ্যের চরম বিকাশকালে এই অঞ্চল মৌর্য সাম্রাজ্যভূক্ত হয়। সমুদ্রগুপ্তের রাজত্বকালে ৩৪০-৩৮০ খ্রিস্টাব্দে এ অঞ্চল সমতট রাজ্যভূক্ত ছিল। গুপ্তযুগে সমতট রাজ্যটিকে প্রশাসনিক ইউনিটে ভাগ করা হয় যথা- ভূক্তি, বিষয়, মন্ডল, বীথি এবং গ্রাম। শৈলকুপা এ সময় কুমার মন্ডলের অন্তর্গত ছিল। ৬৩৯ খ্রি. চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাং সমতট রাজ্য ভ্রমণ করেন। তাঁর ভ্রমণ বিবরণী থেকে জানা যায়, সমতট রাজ্যে ৩০টি বৌদ্ধ সংঘরাম ছিল তম্মধ্যে যশোর জেলার মহেশপুর ও শৈলকুপায় দুটি সংঘরাম ছিল বলে পুরাতত্ত্ববিদ পরেশনাথ মজুমদার উল্লেখ করেন। শৈলকুপা শহরের ২ কি. মি. পশ্চিমে মঠবাড়ি নামক স্থানে বর্তমানে যেখানে কালী পূজা হয়। হয়তো এই স্থানে সংঘরামের (বৌদ্ধমঠ) অস্তিত্ব ছিল বলে অনেক প্রাজ্ঞ জন মনে করেন। তবে এর কোন দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। পাল আমলে বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশের সময় এর অস্তিত্ব থাকা অসম্ভব নয়। এ থেকে প্রমাণ হয় পাল যুগেও শৈলকুপা উল্লেখযোগ্য নগরকেন্দ্র ছিল। সেন রাজগণের রাজত্বকালে বারেন্দ্রদিগের প্রধান সমাজ যশোরের উত্তরাংশে প্রতিষ্ঠিত হয় বলে যশোর-খুলনার ইতিহাসে উল্লেখ আছে। যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের প্রধান সেনাপতি রঘুনাথ রায় ওরফে রঘু বীরের প্রকৃত নিবাস ছিল শৈলকুপায়। তিনি সৌপায়ন গোত্রীয় নাগবংশীয় বারেন্দ্র কায়েস্ত ছিলেন। নাগ বংশের আদি পুরুষ কান্যকুব্জের কোলাঞ্চ নগরী থেকে শৈলকুপায় আসে। এ বংশের শিবরায় নাগের পুত্র কর্কট নাগ ও জটাধর নাগ প্রখ্যাত রাজা বল্লাল সেন (১১৬০-১১৭৮খ্রি.) সমসাময়িক এবং প্রতিদ্বন্দ্বি ছিলেন। এই কর্কট নাগই শৈলকুপায় রাজ্য গড়ে তোলেন। বল্লাল অনুসৃত বর্ণ প্রথায় বিরক্ত হয়ে অসংখ্য নন্দি, চাকি, তাতি ও দাসকুলিনেরা শৈলকুপায় কর্কট নাগের আশ্রয়ে আসেন। তিনি শৈলকুপায় স্থানীয় ও নবাগত বাসিন্দাদের নিয়ে একটি প্রাচুর্যময় রাজ্য গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে তারাউজলিয়া পরগনার অধিশ্বর হয়ে শৈলকুপায় তার রাজধানীতে বাস করতে থাকেন। নাগরাজ বংশের পঞ্চম পুরুষ রাজা শুক্লাম্বর ও শুভংকর দুই নাগরাজের কথা জানা যায়। এর মধ্যে শুক্লাম্বর শৈলকুপায় এবং শুভংকর নাগ শৈলকুপার নাগপাড়া নামক গ্রামে বসবাস করাতে থাকেন। এ বংশের রাজা রাজবল্লভ নাগের পুত্র গোবিন্দ নাগ। তৎপুত্র রঘুনাথ রায় তৎপুত্র রামনারায়ণ তৎপুত্র হরিরামের নাম ইতিহাসে পাওয়া যায়। এই হরিরামের নামের সাথে হরিহরার গড় (ধ্বংসপ্রাপ্ত রাজধানী) নামকরণের যোগসুত্র থাকার কথা অনেকেই অনুমান করেন।
সুলতানি শাসনের পূর্বে বাংলায় যখন পাঠানদের রাজত্ব চলছিল তখন এক পাঠান সেনাপতি হরিহর রাজাকে পরাস্ত ও তার রাজপুরী ধ্বংস করেন সুলতানি আমলে শৈলকুপা একটি জনবহুল কেন্দ্রে পরিণত হয় এবং এ অঞ্চলে মুসলিম আধিপত্য চরমভাবে বিস্তার ঘটে। এর প্রমাণ মেলে পুরনো দুটি মসজিদ। একটি খান জাহানী স্থাপত্যের আদলে নির্মিত শৈলকুপা শাহী মসজিদ, অন্যটি হোসেন শাহী মডেলে নির্মিত হিতামপুর শাহী মসজিদ। ঝিনাইদহ অঞ্চলে মুকুট রায় নামে যে প্রতাপশালী রাজার কথা শোনা যায় তার প্রধান সেনাপতি রঘুপতি ঘোষ রায় এর বাড়ি ছিল বাগুটিয়া। তার দুইজন শক্তিশালী সহযোগী ছিল। একজনের নাম কেশব সরদার অন্য জনের নাম চন্ডি সরদার। মুকুট রায়ের একটি দূর্গ ছিল বাগুটিয়ার নিকটে বর্তমানে কন্যাদহ বিলের ধারে। পাঠান সৈন্যদের হাতে মুকুট রায় এক যুদ্ধে পরাস্ত ও নিহত হলে তার কন্যা ও ২ স্ত্রী বিলের পানিতে ডুবে আত্মহত্যা করেন। যেখানে কন্যা মরেন তার নাম কন্যাদাহ আর যেখানে স্ত্রীগণ মরেন তার নাম দোসতিনে বর্তমানে কন্যাদা ও দোসতিনের বিল নামে এলাকাটি পরিচিত যা যশোর-খুলনার ইতিহাস গ্রন্থে সতিসচন্দ্র মিত্র উল্লেখ করেছেন।
বারো ভূইয়াদের আমলে শৈলকুপা রাজা প্রতাপাদিত্বের অধিনে ছিল মুঘল আমলে সুবেদার ইসলাম খাঁন রাজা প্রতাপাদিত্যকে পরাস্ত করলে এনায়েত খাঁ যশোরের ফৌজদার নিযুক্ত হন। বিভিন্ন সময়ে শৈলকুপা সীতারাম রাজা নলডাঙ্গার রাজা ও নড়াইল জমিদারের অধিনে। এ অঞ্চল সম্পূর্ণরূপে মুঘলদের অধিনে আসে এবং যশোরে একজন সুবেদারের অধিনে শাসন কার্য চলতে থাকে।
নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর বৃটিশ যুগের সূচনা হয় ১৭৮৬ সালে শৈলকুপা যশোর কালেক্ট্রটের অধিনে যায়। ১৮৬৩ সালে শৈলকুপা থানার সৃষ্টি হয়। ১৮৮৯ সালে নীল বিদ্রোহ ছিল শৈলকুপার এক ঐতিহাসিক ঘটনা। শৈলকুপার অদুরে বিজুলীয়া নীল কুটির অধ্যক্ষ ছিলেন মি. ডাম্বল। তিনি ভয়ানক অত্যাচারী ছিলেন। ১৮৮৯ সালে শৈলকুপার ৪৮ গ্রামের কৃষক একত্রিত হয়ে এই নীলকুঠি আক্রমণ করে। এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন ষষ্টিবরের জমিদার বুঙ্কবিহারী মিত্র, বসন্ত মিত্র, সরদার সাখাওয়াতুল্লা, জমির উদ্দিন মন্ডল প্রমুখ। এর পর শুরু হয় পাকিস্তান শাসনামল।
১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল গাড়াগঞ্জ যুদ্ধ, ৪ আগস্ট আলফাপুর যুদ্ধ, ১৩ অক্টোবর আবাইপুর যুদ্ধ, ২৬ নভেম্বর কামান্না ট্রাজেডি, ৮ এপ্রিল ৬ আগস্ট ও ১১ নভেম্বর শৈলকুপা থানা আক্রমণ ও পতনের মধ্যদিয়ে শৈলকুপা শত্রুমুক্ত হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধে এভাবে শৈলকুপার বীরত্বগাঁথা ইতিহাস স্মরণীয় হয়ে আছে।[